সংবাদচর্চা রিপোর্ট :
ওসমান পরিবারের নির্দেশনার বাইরে কেউ যাবেÑ এমন চিন্তা করাটাও চিন্তার বাইরে। কিন্তু তাদের বাইরে গিয়েও যে জয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব তা আগেই জানান দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আলী আহম্মদ চুনকা। অনেক বছর পর বিষয়টি ফের সামনে নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত ওই চেয়ারম্যান কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বর্তমানে একই বিষয়টি পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছেন বন্দরের মাকসুদ হোসেন। তিনি এই পরিবারের বাইরে গিয়ে জয় করেছেন বন্দর উপজেলা।
সাধারণ মানুষ বলছেন, এই পরিবার নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ভয় তাড়া করে। অনেকেই মনে করেন তাদের বাইরে গিয়ে কিছু করে টিকে থাকাটাও দুস্কর। কিন্তু একবার যদি সাহস করে ঘুরে দাঁড়ানো যায় তাহলে এই পরিবারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং এই পরিবারের নেতৃত্বে যারা রয়েছে তারাই উল্টো ভয়ে থাকেন। তাদের মূল ভয়টাই হচ্ছেÑ নিজেদের ইমেজ। যাতে তারা কখনই ইমেজ সঙ্কটে না ভুগেন। মানুষের মধ্যে তাদেরকে ঘিরে যে ভয় কাজ করে সেই ভয়টা যেন কখনই কেটে না যায়। হয়তো এ কারণেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে খুব বেশি ভয় পান। সেই ভয় থেকেই সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যাতে না হয় সেটাই কী এই পরিবারের সব থেকে বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তি শামীম ওসমান চাচ্ছেন, এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মাঝেই।
স্থানীয় অনেকেই সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার পিছনে প্রভাবশালী ওই পরিবারকে দুষছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর শামীম ওসমান বলয়ের বেশ কজন নেতাই চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তবে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ আলোচনা সৃষ্টি হয়েছিল শাহ্ নিজাম ও শাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়া সাজনুকে কেন্দ্র করে। জনশ্রুতি রয়েছে, শামীম ওসমান চাচ্ছেন সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একমাত্র প্রার্থী হবেন শাহ্ নিজাম। তার বলয়ে থাকা অন্যদের নির্বাচন থেকে বসিয়ে দিতেও নাকি চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এতে বাধ সাধে সাজনু। তিনি হার-জিত যাহোক, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করবেন বলেই অনঢ় ছিলেন। আর মাঠ জরিপও বলছিল, শামীম ওসমান যদি শাহ্ নিজামকে সমর্থন করেন এবং এর বিপরীতে যদি সাজনু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাহলে সাজনুর জয় অবধারিত। নির্বাচনী হাওয়া যখন এমন ঠিক তখনই সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে পুরনো সেই মামলাগুলো সামনে এনে রিট করা হয়। এতে করে স্থগিত হয়ে যায় বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝেও ক্ষোভের অন্ত নেই।
সূত্র বলছে, ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বন্দর থেকে বেশ কয়েকজন নির্বাচন করতে চাইলেও তাদেরকে নানা কৌশলে বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওই পরিবারের বিরুদ্ধে। সেবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের সমর্থিত প্রার্থী এম এ রশীদ। এবারও এই পরিবার থেকে এই এম এ রশীদকে সমর্থন করা হয়। পরবর্তীতে এই পরিবারের মেজ ছেলে সেলিম ওসমান চেয়েছিলেন নির্বাচনী মাঠে একমাত্র এম এ রশীদ থাকবেন অন্য যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাচ্ছেন তাদেরকে বসিয়ে দিবেন। কিন্তু তার সেই মিশন ব্যর্থ হলে তিনি ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হোন মাকসুদ হোসেন ও আতাউর রহমান মুকুলের প্রতি। এমনকী বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদেরকে হুমকি ধামকিও দিয়েছিলেন এই সাংসদ। তবে শেষ পর্যন্ত তার সেই হুঙ্কার কোনো কাজে আসেনি। তার বাইরে গিয়ে এই দুজন নির্বাচন করেন এবং তাদের মধ্যে জয় নিশ্চিত করেন মাকসুদ হোসেন। তিনি ওসমান পরিবার সমর্থিত প্রার্থী থেকে দ্বিগুণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হোন। আর এর মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হয়েছে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে সাহস করে একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারলে টিকে যাওয়াটা কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়।
সূত্র আরও বলছে, বন্দরে যে ঘটনা ঘটেছে একই ঘটনা সদরেও ঘটার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। আর সেটি হলে বন্দরের পাশাপাশি সদরে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখাটা কষ্টকর হতো প্রভাবশালী ওই পরিবারের জন্য। ফলে প্রার্থীতা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হয়েতা এই পরিবারও চাচ্ছে না সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হোক। তাদের মধ্যে সাজনুকে ঘিরে এক ধরণের ভয় কাজ করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও সাজনুও এই পরিবারেরই একনিষ্ঠ। তিনি কিংবা শাহ্ নিজাম যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন উপজেলা কিন্তু এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণেই থাকতো। কিন্তু একজনের প্রতি অতিমাত্রার ভালোবাসার কারণে তারা মাঠ উন্মুক্ত রাখতে চাচ্ছেন না বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে খোকা মহিউদ্দিনকে সমর্থন করেছিলেন এ কে এম সামসুজ্জোহা। সে নির্বাচনে আলী আহম্মদ চুনকা নির্বাচন করতে চাইলেও তৎকালিন সংসদ সদস্য সামসুজ্জোহা তাকে সমর্থন করেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি এই পরিবারের সঙ্গে বিরোধীতা করে তাদের প্রর্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়াই করে জয়ী হয়েছিলেন। ২০১১ সালে একইভাবে এই পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।